
দিন দিন বেড়েই চলেছে ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরির ঘটনা। যে হারে ডাকাতি ছিনতাই ও চুরির ঘটনা বাড়ছে সে হারে প্রশাসনের তেমন কোন চোখে পড়ার মত তৎপরতা দেখা যায় না এলাকায়। রাত যত গভীর হয় ততই আতঙ্ক বাড়তে থাকে এ এলাকার মানুষের মধ্যে।
কুমিল্লার লালমাইয়ে আইনশৃংঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় জনসাধারন। গত চার মাসে এই উপজেলায় কমপক্ষে ৮ টি ডাকাতি-ছিনতাইসহ অর্ধশতাধিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসবের নব্বই ভাগই হয়েছে প্রবাসীদের বাড়িতে। চোর ডাকাতদের টার্গেট এখন ‘প্রবাসী পরিবার’। এতে প্রবাসী ও তাদের পরিবারে আতংক বিরাজ করছে।
ভুক্তভোগী পরিবার, প্রবাসী ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়নের নুরপুরের সীমান্তবর্তী আলোকদিয়া গ্রামের মৃত সামছুল হকের ছেলে ইতালি প্রবাসী আজিজুল হক খোকন ও ফ্রান্স প্রবাসী জহিরুল হক রিপনের বাড়িতে মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত ১.৪০ ঘটিকায় পুলিশ পরিচয়ে দুধর্ষ ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা প্রবাসীর ভগ্নিপতি কে বেঁধে ও পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ঘরের আলমারিতে থাকা নগদ এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা, ১২ ভরি স্বর্ণলংকার ও ১টি এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট লুট করে নিয়ে যায়।
গত ৭ ডিসেম্বর রাত ৩ ঘটিকায় উপজেলার বাগমারা উত্তর ইউনিয়নের দত্তপুর পশ্চিমপাড়ার হাবিবুর রহমানের দুই ছেলে সৌদি প্রবাসী মিনহাজ উদ্দিন সবুজ ও সালমান জাহান সজিবের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা প্রবাসীদের ঘরের আলমারি ভেঙ্গে নগদ তিন লক্ষ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে এবং প্রবাসীদের পিতা হাবিবুর রহমান (৬০) কে কুপিয়ে জখম করে। ঘটনার পর থেকে তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ৩ ঘটিকায় পেরুল উত্তর ইউনিয়নের জগতপুর গ্রামের আমিনুল হক মজুমদার মেম্বারের প্রবাসী ছেলে শাহজালালের ঘরে দুধর্ষ ডাকাতি হয়। ডাকাতরা প্রবাসীর পিতাকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ঘরে থাকা নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ডাকাতরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। ডাকাতির একমাস পর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রবাসীর পিতা মৃত্যুবরণ করেন।
একই রাতে উপজেলার বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের সৌদি প্রবাসী কবির হোসেনের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা পরিবারের সদস্যদের মারধর করে নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ১.৩০ ঘটিকায় উপজেলার বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বেসরকারি চাকরিজীবি কমল সিংহের বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
এছাড়াও কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের কাঁচিকাটা ও কুমিল্লা-বাঙ্গড্ডা সড়কের কলমিয়ায় তিনটি ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এদের দুটিতেই প্রবাস ফেরতরা ভুক্তভোগী। তবে এই দুই ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
আলোকদিয়ার ডাকাতির ঘটনায় প্রবাসীদের ভগ্নিপতি, কুমিল্লার রেইসকোর্স এলাকার বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মাকসুদ মজুমদার রাসেল বলেন, আমার বৃদ্ধা শ্বাশুড়ী বাড়িতে একা থাকে। সে কারনে আমি পরিবার নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকি। সোমবার দিবাগত রাত অনুমান ১.১৫টায় কিছু লোক বাহিরে থেকে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। কে ? প্রশ্ন করলে বাহিরে থেকে বলে আমরা পুলিশ। ঘরে আসামী আছে। দরজা খুলুন। আমরা তখন বলি কোন আসামী ঘরে নেই। আপনারা দিনে আসুন। কিছুক্ষণ পর তারা পাকা ভবনটির কলাপসিবল গেইটের তালা ও ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে।
তিনি আরো বলেন, ৪/৫জন ডাকাত ঘরে প্রবেশ করে। সকলের মুখে কালো মুখোশ ছিল। শুধু চোখ দেখা গেছে। তাদের হাতে ছেনি, রড, ছুরি ও জয়েন্ট পাইপি ছিল। ঘরে প্রবেশ করেই আমার বাম হাতে ছুরিকাঘাত করে এবং পুরনো কাপড় দিয়ে আমাকে বেঁধে সামনের রুমে ফেলে রাখে। তারা ভিতরের রুমে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তিনটি স্টিলের আলমারি ও দুইটি কাঠের আলমারি ভাঙ্গে এবং আলমারির ভিতরে থাকা ১২ভরি স্বর্ণ, নগদ ১লক্ষ ২০ হাজার টাকা ও আমার শ্বাশুড়ীর একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট লুট করে নিয়ে যায়।
সৌদি প্রবাসী মো: কামাল হোসেন বলেন, আমরা প্রবাসীরা বিদেশে কষ্ট করে অর্থ আয় করে দেশে পাঠাই। পরিবারের জন্য স্বর্ণালংকার পাঠাই। দেশের রেমিটেন্স বাড়াই। অথচ আমাদের পরিবারের নিরাপত্তা নেই। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন প্রবাসীর বাড়িতে চুরি ডাকাতির খবর পাচ্ছি। অতিদ্রুত চুরি ডাকাতি বন্ধে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এদিকে বাগমারা উত্তর ইউনিয়নের নাওড়া গ্রামের এক স্থানীয় বাসিন্দা নাম (প্রকাশে অনিচ্ছুক) আলোকিত সকালকে জানায়, মগবাড়ি থেকে বাগমারা রোড হয়ে নাওড়া, চৌরাস্তা হয়ে কেশনপাড় পর্যন্ত রাস্তা দিয়ে সাধারন মানুষ দিনের বেলায় হাঁটাচলা করতে ও আতঙ্কিত থাকে। কেননা এই রাস্তায় প্রতিনিয়ত আড্ডা দেয় চিন্তাই ডাকাতির গেং মাস্টাররা। বেশিরভাগ আড্ডা দেয় নাওড়া চৌরাস্তার সিরাজ মিয়ার বাড়ির সামনের রাস্তায়। এই এলাকার অনেক মহিলা এ রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার সময় চিন্তাইয়ের স্বীকার ও শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।
নির্দিষ্ট সুত্রে জানা যায়, চিন্তাই ডাকাতির সাথে যরিতদের শেল্টারদাতারাও স্থানীয় রাজনীতিবিদ। তারা তাদের সার্থে তাদের ব্যবহার করে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও টাকার বিনিময়ে ২ দিন পর আবার চলে আসে।
স্থানীয় আরেকজন বাসিন্দা জানান, জেলখানা তাদের মামার বাড়ি গয়ে গেছে, আসে আর যায়। প্রশাসন হলো টাকার পাগল। গেং মাস্টাররা টাকা দিয়ে তাদের কিনে ফেলে। তাদের বিরুদ্ধে (গেং মাস্টার) কেউ মুখ খুললে তার উপর আরো অত্যাচার নিপীড়ন আরো বেড়ে যায়। আমরা প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লালমাই থানার সেকেন্ড অফিসার আশরাফুল ইসলাম বলেন, গত ৪ মাসে থানায় একটি ডাকাতির চেষ্টা ও দুইটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। জগতপুরের প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় এই পর্যন্ত ৮জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সড়কে ডাকাতির চেষ্টাকালে পুলিশ ৫জনকে গ্রেফতার করেছে। দত্তপুরের প্রবাসীর বাড়ির ডাকাতির ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর আলোকদিয়ায় প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় এখনো মামলা রুজু হয়নি। তবে আমরা ওই অঞ্চলে পুলিশের টহল ব্যবস্থা জোরদার করছি।
লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, চুরি-ডাকাতি আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে, এটা সত্য। ডাকাতরা প্রবাসী ও বিত্তশালীদের টার্গেট করেই চুরি ডাকাতি করছে। আমরাও রাতে টহল বাড়িয়েছি। যেখানেই চুরি ডাকাতির খবর পাচ্ছি সেখানেই পুলিশ পৌঁছে যাচ্ছে।