Dhaka 9:05 pm, Friday, 14 March 2025

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ: সেনাপতি থেকে স্বৈরশাসক

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত সময় হিসেবে ধরা হয়। তার সামরিক শাসনকাল থেকে রাজনৈতিক দমন, নির্বাচনী জালিয়াতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং ইসলামপন্থার অপব্যবহার—এসব কিছুর মধ্য দিয়ে তার শাসনের নেগেটিভ দিকগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। নিচে তার শাসনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের ব্যত্যয়
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তিনি সামরিক শাসন জারি করেন এবং দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে আসেন, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বিপরীত ছিল। তার এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সৃষ্টি হয় এবং দেশের জনগণ নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
এটি ছিল তার স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রথম প্রকাশ, যেখানে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে সামরিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এরশাদের ক্ষমতা দখল ছিল তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফসল, যা দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
রেফারেন্স:
Islam, Syed Serajul. “Military Rule and the Politics of Islam in Bangladesh.” Asian Survey, vol. 29, no. 10, 1989, pp. 1042–1058.
২. দমনমূলক শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
এরশাদের শাসনকাল ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তার শাসনের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, গ্রেফতার, এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এবং বামপন্থী দলগুলোকে প্রায়ই কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো, এবং তাদের আন্দোলনগুলোকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ব্যবহার করা হতো।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার এরশাদের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে, তার শাসনামলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ধারাবাহিকতা তার শাসনের একটি অন্যতম নেতিবাচক দিক ছিল, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
রেফারেন্স:
Human Rights Watch, “Bangladesh: History of Human Rights Violations under the Ershad Regime,” 1989.
৩. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস ও সেন্সরশিপ
এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তার শাসনের সমালোচনা করার কারণে বহু পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। এরশাদ সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করে, যার ফলে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারেননি।
এরশাদ শাসনামলে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে তার শাসনের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানো হতো, যা ছিল একটি প্রামাণ্য উদাহরণ কিভাবে গণমাধ্যমকে জনগণের মন নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংবাদমাধ্যমের এই নিয়ন্ত্রণ তার স্বৈরাচারী শাসনের একটি বড় উদাহরণ।
রেফারেন্স:
Schendel, Willem van. A History of Bangladesh. Cambridge University Press, 2009.
৪. নির্বাচনী জালিয়াতি ও প্রহসনমূলক নির্বাচন
এরশাদের শাসনের সবচেয়ে বড় নেগেটিভ দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রহসনমূলক নির্বাচন। ১৯৮৬ সালে তিনি একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন, যেখানে ব্যাপক জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করলেও, তাদের অবস্থানকে উপেক্ষা করে এরশাদ সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করে।
এর মাধ্যমে তিনি নিজের ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে “প্রহসনমূলক” হিসেবে বর্ণনা করে এবং এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গভীর আস্থার সংকট দেখা দেয়।
এই ধরনের নির্বাচনী জালিয়াতি গণতন্ত্রের প্রতি তার অবজ্ঞার একটি প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।
রেফারেন্স:
Rahman, Waliur. The Political Career of Hussain Muhammad Ershad. Dhaka: Academic Press, 1996.
৫. ইসলামপন্থার অপব্যবহার ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতার ব্যবহার
এরশাদ তার শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামপন্থাকে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সংবিধানে সংশোধনী এনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এই পদক্ষেপটি ছিল তার শাসনের একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা, যা তিনি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।
এটি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল, যা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। এরশাদের এই পদক্ষেপ শুধু ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ব্যবহার করেই তার শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করেছিল।
রেফারেন্স:
Riaz, Ali. God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh. Rowman & Littlefield, 2004.
৬. উপজেলা ব্যবস্থা: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস?
যদিও এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, যা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ছিল, এটি বাস্তবে তার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীয়ভাবে কুক্ষিগত রাখার একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এরশাদ তার রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আরও সুসংহত করতে এবং স্থানীয় পর্যায়েও তার প্রভাব বিস্তারের জন্য এই ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিলেন।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নামে এই ব্যবস্থা আসলে ছিল তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তৃণমূল পর্যায়ে আরও জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা, যা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আসল উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করেছিল।
রেফারেন্স:
Khan, Mohammad Mohabbat. “Decentralization in Bangladesh: Myth or Reality?” The Bangladesh Development Studies, vol. 15, no. 4, 1987, pp. 85-108.
৭. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা
এরশাদের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তার শাসনের শেষের দিকে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা হলেও, সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল অপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ।
সামাজিক দিক থেকে, তার শাসনকাল ছিল ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের সময়, যা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করেছিল। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন এবং শ্রমিক আন্দোলনগুলো তার শাসনের সময় তীব্র হয়ে ওঠে, এবং এরশাদ সরকার এসব আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়।
রেফারেন্স:
Hossain, Naomi. Elite Perceptions of Poverty in Bangladesh. University Press Limited, 2005.
উপসংহার
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালকে একটি দমনমূলক এবং স্বৈরাচারী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। তার শাসনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ, এবং প্রহসনমূলক নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বিপন্ন করেছিল। তার শাসনের নেগেটিভ দিকগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে
লেখা: প্রফেসর আসাদুজ্জামান সুমন,  প্রবাসী শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, সহ সম্পাদক, দৈনিক নতুন দিগন্ত

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

বিনামূল্যে ব্রেকিং নিউজ পেতে ok ক্লিক করুন OK .

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ: সেনাপতি থেকে স্বৈরশাসক

Update Time : 10:45:53 pm, Wednesday, 23 October 2024
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত সময় হিসেবে ধরা হয়। তার সামরিক শাসনকাল থেকে রাজনৈতিক দমন, নির্বাচনী জালিয়াতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং ইসলামপন্থার অপব্যবহার—এসব কিছুর মধ্য দিয়ে তার শাসনের নেগেটিভ দিকগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। নিচে তার শাসনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের ব্যত্যয়
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তিনি সামরিক শাসন জারি করেন এবং দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে আসেন, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বিপরীত ছিল। তার এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সৃষ্টি হয় এবং দেশের জনগণ নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
এটি ছিল তার স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রথম প্রকাশ, যেখানে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে সামরিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এরশাদের ক্ষমতা দখল ছিল তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফসল, যা দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
রেফারেন্স:
Islam, Syed Serajul. “Military Rule and the Politics of Islam in Bangladesh.” Asian Survey, vol. 29, no. 10, 1989, pp. 1042–1058.
২. দমনমূলক শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
এরশাদের শাসনকাল ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তার শাসনের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, গ্রেফতার, এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এবং বামপন্থী দলগুলোকে প্রায়ই কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো, এবং তাদের আন্দোলনগুলোকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ব্যবহার করা হতো।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার এরশাদের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে, তার শাসনামলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ধারাবাহিকতা তার শাসনের একটি অন্যতম নেতিবাচক দিক ছিল, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
রেফারেন্স:
Human Rights Watch, “Bangladesh: History of Human Rights Violations under the Ershad Regime,” 1989.
৩. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস ও সেন্সরশিপ
এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তার শাসনের সমালোচনা করার কারণে বহু পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। এরশাদ সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করে, যার ফলে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারেননি।
এরশাদ শাসনামলে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে তার শাসনের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানো হতো, যা ছিল একটি প্রামাণ্য উদাহরণ কিভাবে গণমাধ্যমকে জনগণের মন নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংবাদমাধ্যমের এই নিয়ন্ত্রণ তার স্বৈরাচারী শাসনের একটি বড় উদাহরণ।
রেফারেন্স:
Schendel, Willem van. A History of Bangladesh. Cambridge University Press, 2009.
৪. নির্বাচনী জালিয়াতি ও প্রহসনমূলক নির্বাচন
এরশাদের শাসনের সবচেয়ে বড় নেগেটিভ দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রহসনমূলক নির্বাচন। ১৯৮৬ সালে তিনি একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন, যেখানে ব্যাপক জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করলেও, তাদের অবস্থানকে উপেক্ষা করে এরশাদ সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করে।
এর মাধ্যমে তিনি নিজের ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে “প্রহসনমূলক” হিসেবে বর্ণনা করে এবং এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গভীর আস্থার সংকট দেখা দেয়।
এই ধরনের নির্বাচনী জালিয়াতি গণতন্ত্রের প্রতি তার অবজ্ঞার একটি প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।
রেফারেন্স:
Rahman, Waliur. The Political Career of Hussain Muhammad Ershad. Dhaka: Academic Press, 1996.
৫. ইসলামপন্থার অপব্যবহার ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতার ব্যবহার
এরশাদ তার শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামপন্থাকে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সংবিধানে সংশোধনী এনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এই পদক্ষেপটি ছিল তার শাসনের একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা, যা তিনি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।
এটি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল, যা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। এরশাদের এই পদক্ষেপ শুধু ধর্মীয় সংবেদনশীলতা ব্যবহার করেই তার শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করেছিল।
রেফারেন্স:
Riaz, Ali. God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh. Rowman & Littlefield, 2004.
৬. উপজেলা ব্যবস্থা: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস?
যদিও এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, যা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ছিল, এটি বাস্তবে তার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীয়ভাবে কুক্ষিগত রাখার একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এরশাদ তার রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আরও সুসংহত করতে এবং স্থানীয় পর্যায়েও তার প্রভাব বিস্তারের জন্য এই ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিলেন।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নামে এই ব্যবস্থা আসলে ছিল তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তৃণমূল পর্যায়ে আরও জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা, যা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আসল উদ্দেশ্যকে ক্ষুন্ন করেছিল।
রেফারেন্স:
Khan, Mohammad Mohabbat. “Decentralization in Bangladesh: Myth or Reality?” The Bangladesh Development Studies, vol. 15, no. 4, 1987, pp. 85-108.
৭. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা
এরশাদের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তার শাসনের শেষের দিকে দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলা হলেও, সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল অপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ।
সামাজিক দিক থেকে, তার শাসনকাল ছিল ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের সময়, যা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করেছিল। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন এবং শ্রমিক আন্দোলনগুলো তার শাসনের সময় তীব্র হয়ে ওঠে, এবং এরশাদ সরকার এসব আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়।
রেফারেন্স:
Hossain, Naomi. Elite Perceptions of Poverty in Bangladesh. University Press Limited, 2005.
উপসংহার
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালকে একটি দমনমূলক এবং স্বৈরাচারী শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। তার শাসনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ, এবং প্রহসনমূলক নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বিপন্ন করেছিল। তার শাসনের নেগেটিভ দিকগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে
লেখা: প্রফেসর আসাদুজ্জামান সুমন,  প্রবাসী শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, সহ সম্পাদক, দৈনিক নতুন দিগন্ত