Dhaka 1:11 pm, Saturday, 15 March 2025

খেজুরগাছের ইতিবৃত্ত

রস আহরনের জন্য প্রস্তুত খেজুরগাছঃ
আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুরগাছকে প্রস্তুত করতে হয় । খেজুর গাছের মাথার দিকের এক পাশের বাকল কেটে ‘গাছ তোলা’ হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি(স্থানীয় ভাষায় দড়া বলে) বেঁধে ধারালো গাছি দা খেজুর গাছ কাটার দা) দিয়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করা হয়।
আহরিত রসের ব্যবহারঃ
এ অঞ্চলের মানুষ রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। বানানো হয় নানা ধরনের পাটালি। আকৃতি, রং ও স্বাদে থাকে ভিন্নতা। এখানকার মানুষের কাছে নারিকেল দিয়ে তৈরী পাটালি বিশেষ পছন্দনীয়। এই পাটালি পাঠানো হয় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে।
বিশেষজ্ঞদের ধারনাঃ
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, এই অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দো-আঁশ। আর পানিতে লবণাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিঁকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খাজুরা, বাঘারপাড়া, চৌগাছা, মাগুরার শালিখার খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
ইতিহাসের পাতা থেকেঃ
১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখলের পর দলে দলে সাহেবরা বিলেত থেকে এ দেশে আসতেন। মিস্টার বাকলে নামে এক সাহেব চিনি তৈরির ব্যবসায়ে নামেন। তিনি বর্ধমান জেলার (বর্তমানে ভারত) ধোবাতে একটি বড় ধরনের চিনি কারখানা স্থাপন করেন। যশোর থেকে খেজুরের গুড় নিয়ে চিনি তৈরি শুরু করেন। পরিবহন খরচ বেশি পড়ায় তিনি কোটচাঁদপুর ও ত্রিমোহনীতে দুটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত মি. বাকলে সাহেবের কারখানা দুটো ভালোই চলে। এরপর লোকসানের পালা শুরু হয়। এরপর এক ইংরেজ সাহেব কোটচাঁদপুর ফ্যাক্টরি কিনে নেন। পরে সেন্টস ব্যারি নামে আরেক সাহেব ত্রিমোহনী ফ্যাক্টরি কিনে নেন। যশোর ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বর্ণিত তথ্যে জানা যায়, ১৮৪২ সালে কলকাতায় বসবাসরত সাহেবগণ “গ্যাডস্টোন অ্যান্ড কোম্পানি ”গঠন করে চিনি ব্যবসায়ে নামেন। তারা চৌগাছাতে একটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। এ ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছিলেন মি. স্মিথ নামে এক বিলেতি। পরে ম্যাকলিউড নামে আরেক সাহেব ম্যানেজার হন। ম্যাকলিউড পরিবারের অনেক স্মৃতি এখনো কোটচাঁদপুরে আছে। কোটচাঁদপুর ছাড়াও ঝিকরগাছা, ত্রিমোহনী, চৌগাছা, নারকেলবাড়িয়াতে এ কোম্পানির আরো চিনি ফ্যাক্টরি ছিল। তিন-চার বছর এসব ফ্যাক্টরি ভালো চলে। পরে লোকসান শুরু হতে থাকে। ১৮৫০ সালের পরও কোটচাঁদপুর ও চৌগাছার ফ্যাক্টরি দুটো চালু ছিল। ১৮৫৩ সালে মি. নিউ হাউজ তাহেরপুরে একটি বড় আকারের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। তিন- চার বছর চলার পর লোকসান শুরু হয়। পরে চিনি তৈরি বন্ধ করে এ কারখানাতে ‘রাম’ মদ তৈরি হতো। খান বাহাদুর এম এ মোমেন ফাইনাল রিপোর্ট অন দি সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব যশোর বইতে লিখেছেন, ১৯০৮ সালের দিকে যশোর অঞ্চলে ৬০ লাখ খেজুরগাছ ছিল। এ গাছ থেকে ২৫ লাখ মণ গুড় তৈরি হতো। অবশ্য এ সময়ে খেজুর থেকে চিনি তৈরি প্রায় উঠে গিয়েছিল।
খেজুর গাছের পরিসংখ্যানঃ
বড়ই পরিতাপের বিষয় দিনদিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৃক্ষ নিধনকারীদের নজর পড়েছে খেজুরগাছের উপর।প্রতিনিয়ত ইটভাটা বাড়ছে,সেই ইটভাটার কারনে খেজুর গাছ নিধন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষাবাদের কারনে খেজুরগাছের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে।
সাধারণ মানুষের বক্তব্যঃ
উপজেলার শ্যামকূড় ইউনিয়নের হালসা কৃষক হাসান আলী বলেন, আমার পিতা প্রায় ২৫০-৩০০টি খেঁজুর গাছ থেকে রস আহরন করতেন। প্রত্যেক দিন কমপক্ষে ৫০/৬০ ভাড়(রস আহরনের পাত্রকে স্থানীয় ভাষায় হাড়ি বা ভাড় বলে) রস হতো। এগুলো জ্বালিয়ে ৫/৬ ভাড় করে গুড় হয়েছে। গ্রামে ইটভাটা হওয়ার পর একে একে সব খেঁজুর গাছে উজাড় হয়ে গেছে। এখনও বেশকিছু গাছ আছে কিন্তু সেগুলি কাটার লোক(গাছি) নেই!
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মণিরামপুর উপজেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতার ধারক ও বাহক খেঁজুর গাছকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সরকারিভাবে নতুন করে খেঁজুর লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
একজন গাছির বক্তব্যঃ
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের গাছি আব্দুস সামাদ (৬৫) গোলদার। (খেজুর গাছ কেটে রস গুড় উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে স্থানীয় ভাষায় গাছি বলে)। প্রায় ৫০ বছর তিনি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। সামাদ গাছি জানান, গত বছর শীতের তিন মাসে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে এবং অন্য মানুষের খেজুরগাছ রস সংগ্রহের উপযোগী করার কাজ করে প্রায় দেড় লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। তবে তাঁর ছেলে এ পেশায় আসতে চান না। কারণ গাছে ওঠা, রস নিয়ে নামা বেশ কষ্টের ব্যাপার।
কৃষি অফিসের তথ্য মতে বর্তমানের চিত্রঃ
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের তথ্যে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে যশোরে খেজুরগাছের সংখ্যা বাড়লেও কমে যাচ্ছে রস ও গুড় উৎপাদন। তাদের হিসাবে ২০১৯ সালে জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি, যা কমতে কমতে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টিতে। তবে ২০২৪ সালে গাছের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৮০টিতে। অন্যদিকে ২০২৩ সালে রস আহরণকারী গাছের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি। ২০২৪ সালে আহরণকারী গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ চার হাজার পাঁচটিতে। ২০২৩ সালে গুড় উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৬৬৯ টন। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৪০ মেট্রিক টনে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাবে যশোর জেলায় গাছি রয়েছেন পাঁচ হাজার ১২৫ জন এবং এ জেলায় গুড় উৎপাদন হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকার।
অতীত ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভবঃ
গাছি ও খেজুরগাছ মালিকরা খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদন দ্রুতই দ্বিগুণ করা সম্ভব। তাঁরা বলছেন, নারকেলগাছে ওঠার সহজ যন্ত্রের মতো খেজুরগাছে ওঠার জন্য সহজে বহন ও ব্যবহার উপযোগী কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন আবার ফিরিয়ে আনতে পারে খেজুর রসের গুড়ের সুদিনও অতীত ্ঐতিহ্য। স¤প্রতি যশোর জেলার কয়েকটি উপজেলায় ঘুরে গাছিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে দেশে নারকেলগাছে ওঠার যন্ত্র থাকলেও খেজুরগাছে ওঠার কোনো যন্ত্র নেই বলে কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্যঃ
উপজেলা কৃষি অফিসার ঋতুরাজ সরকার বলেন, যশোরের ঐতিহ্য খেঁজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ২০০৯ সাল থেকে এ অঞ্চলে খেঁজুর গাছ রোপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতে খেঁজুরের বীজ/চারা রোপন করা হয়। গাছ কাটার জন্য গাছিদের প্রশিক্ষণ ও গাছে উঠার উপকরণ সহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খেঁজুর গাছ থেকে রস আরোহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে গাছির সংকট নিরসন হবে এবং শ্রমজীবি যুবকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত হলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং যশোর অঞ্চলের খেুঁজুরের গুড়-রসের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) প্রতাপ মন্ডল বলেন, খেজুরগাছে ওঠানামার জন্য দেশে এখনো এমন কোনো যন্ত্র নেই। এমন যন্ত্রের প্রয়োজনীতার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

বিনামূল্যে ব্রেকিং নিউজ পেতে ok ক্লিক করুন OK .

খেজুরগাছের ইতিবৃত্ত

Update Time : 08:39:49 pm, Thursday, 19 December 2024

রস আহরনের জন্য প্রস্তুত খেজুরগাছঃ
আশ্বিনের শেষের দিকে খেজুরগাছকে প্রস্তুত করতে হয় । খেজুর গাছের মাথার দিকের এক পাশের বাকল কেটে ‘গাছ তোলা’ হয়। গাছ তোলা শেষে গাছ কাটার পালা। কোমরে মোটা দড়ি(স্থানীয় ভাষায় দড়া বলে) বেঁধে ধারালো গাছি দা খেজুর গাছ কাটার দা) দিয়ে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে গাছ কেটে রস আহরণ করা হয়।
আহরিত রসের ব্যবহারঃ
এ অঞ্চলের মানুষ রস ও গুড় দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। বানানো হয় নানা ধরনের পাটালি। আকৃতি, রং ও স্বাদে থাকে ভিন্নতা। এখানকার মানুষের কাছে নারিকেল দিয়ে তৈরী পাটালি বিশেষ পছন্দনীয়। এই পাটালি পাঠানো হয় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে।
বিশেষজ্ঞদের ধারনাঃ
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, এই অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দো-আঁশ। আর পানিতে লবণাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিঁকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খাজুরা, বাঘারপাড়া, চৌগাছা, মাগুরার শালিখার খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
ইতিহাসের পাতা থেকেঃ
১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতা দখলের পর দলে দলে সাহেবরা বিলেত থেকে এ দেশে আসতেন। মিস্টার বাকলে নামে এক সাহেব চিনি তৈরির ব্যবসায়ে নামেন। তিনি বর্ধমান জেলার (বর্তমানে ভারত) ধোবাতে একটি বড় ধরনের চিনি কারখানা স্থাপন করেন। যশোর থেকে খেজুরের গুড় নিয়ে চিনি তৈরি শুরু করেন। পরিবহন খরচ বেশি পড়ায় তিনি কোটচাঁদপুর ও ত্রিমোহনীতে দুটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত মি. বাকলে সাহেবের কারখানা দুটো ভালোই চলে। এরপর লোকসানের পালা শুরু হয়। এরপর এক ইংরেজ সাহেব কোটচাঁদপুর ফ্যাক্টরি কিনে নেন। পরে সেন্টস ব্যারি নামে আরেক সাহেব ত্রিমোহনী ফ্যাক্টরি কিনে নেন। যশোর ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বর্ণিত তথ্যে জানা যায়, ১৮৪২ সালে কলকাতায় বসবাসরত সাহেবগণ “গ্যাডস্টোন অ্যান্ড কোম্পানি ”গঠন করে চিনি ব্যবসায়ে নামেন। তারা চৌগাছাতে একটি বড় চিনি ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। এ ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ছিলেন মি. স্মিথ নামে এক বিলেতি। পরে ম্যাকলিউড নামে আরেক সাহেব ম্যানেজার হন। ম্যাকলিউড পরিবারের অনেক স্মৃতি এখনো কোটচাঁদপুরে আছে। কোটচাঁদপুর ছাড়াও ঝিকরগাছা, ত্রিমোহনী, চৌগাছা, নারকেলবাড়িয়াতে এ কোম্পানির আরো চিনি ফ্যাক্টরি ছিল। তিন-চার বছর এসব ফ্যাক্টরি ভালো চলে। পরে লোকসান শুরু হতে থাকে। ১৮৫০ সালের পরও কোটচাঁদপুর ও চৌগাছার ফ্যাক্টরি দুটো চালু ছিল। ১৮৫৩ সালে মি. নিউ হাউজ তাহেরপুরে একটি বড় আকারের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। তিন- চার বছর চলার পর লোকসান শুরু হয়। পরে চিনি তৈরি বন্ধ করে এ কারখানাতে ‘রাম’ মদ তৈরি হতো। খান বাহাদুর এম এ মোমেন ফাইনাল রিপোর্ট অন দি সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অব যশোর বইতে লিখেছেন, ১৯০৮ সালের দিকে যশোর অঞ্চলে ৬০ লাখ খেজুরগাছ ছিল। এ গাছ থেকে ২৫ লাখ মণ গুড় তৈরি হতো। অবশ্য এ সময়ে খেজুর থেকে চিনি তৈরি প্রায় উঠে গিয়েছিল।
খেজুর গাছের পরিসংখ্যানঃ
বড়ই পরিতাপের বিষয় দিনদিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৃক্ষ নিধনকারীদের নজর পড়েছে খেজুরগাছের উপর।প্রতিনিয়ত ইটভাটা বাড়ছে,সেই ইটভাটার কারনে খেজুর গাছ নিধন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষাবাদের কারনে খেজুরগাছের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে গেছে।
সাধারণ মানুষের বক্তব্যঃ
উপজেলার শ্যামকূড় ইউনিয়নের হালসা কৃষক হাসান আলী বলেন, আমার পিতা প্রায় ২৫০-৩০০টি খেঁজুর গাছ থেকে রস আহরন করতেন। প্রত্যেক দিন কমপক্ষে ৫০/৬০ ভাড়(রস আহরনের পাত্রকে স্থানীয় ভাষায় হাড়ি বা ভাড় বলে) রস হতো। এগুলো জ্বালিয়ে ৫/৬ ভাড় করে গুড় হয়েছে। গ্রামে ইটভাটা হওয়ার পর একে একে সব খেঁজুর গাছে উজাড় হয়ে গেছে। এখনও বেশকিছু গাছ আছে কিন্তু সেগুলি কাটার লোক(গাছি) নেই!
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মণিরামপুর উপজেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতার ধারক ও বাহক খেঁজুর গাছকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সরকারিভাবে নতুন করে খেঁজুর লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
একজন গাছির বক্তব্যঃ
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের গাছি আব্দুস সামাদ (৬৫) গোলদার। (খেজুর গাছ কেটে রস গুড় উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে স্থানীয় ভাষায় গাছি বলে)। প্রায় ৫০ বছর তিনি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন। সামাদ গাছি জানান, গত বছর শীতের তিন মাসে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে এবং অন্য মানুষের খেজুরগাছ রস সংগ্রহের উপযোগী করার কাজ করে প্রায় দেড় লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। তবে তাঁর ছেলে এ পেশায় আসতে চান না। কারণ গাছে ওঠা, রস নিয়ে নামা বেশ কষ্টের ব্যাপার।
কৃষি অফিসের তথ্য মতে বর্তমানের চিত্রঃ
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের তথ্যে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে যশোরে খেজুরগাছের সংখ্যা বাড়লেও কমে যাচ্ছে রস ও গুড় উৎপাদন। তাদের হিসাবে ২০১৯ সালে জেলায় খেজুরগাছের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি, যা কমতে কমতে ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টিতে। তবে ২০২৪ সালে গাছের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ২৩ হাজার ৪৮০টিতে। অন্যদিকে ২০২৩ সালে রস আহরণকারী গাছের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি। ২০২৪ সালে আহরণকারী গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় তিন লাখ চার হাজার পাঁচটিতে। ২০২৩ সালে গুড় উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৬৬৯ টন। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৪০ মেট্রিক টনে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাবে যশোর জেলায় গাছি রয়েছেন পাঁচ হাজার ১২৫ জন এবং এ জেলায় গুড় উৎপাদন হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকার।
অতীত ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভবঃ
গাছি ও খেজুরগাছ মালিকরা খেজুরের রস ও গুড় উৎপাদন দ্রুতই দ্বিগুণ করা সম্ভব। তাঁরা বলছেন, নারকেলগাছে ওঠার সহজ যন্ত্রের মতো খেজুরগাছে ওঠার জন্য সহজে বহন ও ব্যবহার উপযোগী কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন আবার ফিরিয়ে আনতে পারে খেজুর রসের গুড়ের সুদিনও অতীত ্ঐতিহ্য। স¤প্রতি যশোর জেলার কয়েকটি উপজেলায় ঘুরে গাছিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে দেশে নারকেলগাছে ওঠার যন্ত্র থাকলেও খেজুরগাছে ওঠার কোনো যন্ত্র নেই বলে কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্যঃ
উপজেলা কৃষি অফিসার ঋতুরাজ সরকার বলেন, যশোরের ঐতিহ্য খেঁজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ২০০৯ সাল থেকে এ অঞ্চলে খেঁজুর গাছ রোপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতে খেঁজুরের বীজ/চারা রোপন করা হয়। গাছ কাটার জন্য গাছিদের প্রশিক্ষণ ও গাছে উঠার উপকরণ সহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খেঁজুর গাছ থেকে রস আরোহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে গাছির সংকট নিরসন হবে এবং শ্রমজীবি যুবকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত হলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং যশোর অঞ্চলের খেুঁজুরের গুড়-রসের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) প্রতাপ মন্ডল বলেন, খেজুরগাছে ওঠানামার জন্য দেশে এখনো এমন কোনো যন্ত্র নেই। এমন যন্ত্রের প্রয়োজনীতার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।