Dhaka 9:15 am, Saturday, 15 March 2025

খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি-আতঙ্কে বরাদ্দ চাল তুলছেন না পরিবেশকেরা

ছবি : মনিরামপুর উপজেলা খাদ্য গুদাম

যশোরের মনিরামপুরে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির কার্ডধারী গ্রাহকদের মাঝে সেপ্টেম্বর মাসের চাল বিতরণের জন্য ৭০০ টন চালের বরাদ্দ এসেছে গেল আগষ্ট মাসে। চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে চাল তুলে বিতরণের জন্য পরিবেশকদের নির্দেশনা দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত কোন পরিবেশক ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চাল উত্তোলন করেননি বলে জানা গেছে।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, মনিরামপুর উপজেলায় খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২৩ হাজার ১৯৫ জন উপকারভোগী রয়েছেন। উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে উপকারভোগীদের কাছে ১৫ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রির জন্য পরিবেশক রয়েছে ৪৬ জন। যাদের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। গেল ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব পরিবেশকদের অধিকাংশের কাছ থেকে জোর করে কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে ডিলারশীপ কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পরিবেশক জানান, বছরের মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এই পাঁচ মাস কার্ডধারীদের কাছে চাল বিক্রি করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের চাল বিতরণের জন্য গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার খাদ্য অফিস থেকে আমাদের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হয়েছে, আমরা চাল উত্তোলন করব কি না। তাঁরা ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ জবাব চেয়েছেন। পরে আমরা পরিবেশকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপদে চাল তুলে বিতরণ করতে পারব কি না সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। এজন্য কেউ চাল তুলতে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়নি।

নাম প্রকাশ না করে এক পরিবেশক বলেছেন, রাজনীতির পট পরিবর্তনের পর থেকে চালের ডিলারশীপ ছেড়ে দিতে আমাকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। অবশেষে ২০-২৫ জন লোক আমাকে মাঠের মধ্যে কাজ করা অবস্থায় সেখানে ধরে জোর করে প্রত্যাহার কাগজে স্বাক্ষর করে নিয়েছে। লোকজন সরে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি উপজেলা কমিটিকে ফোনে জানিয়েছি। আরেক পরিবেশক জানান, অনেক লোক এসে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে। পরিস্থিতি দেখে কথা বলতে সাহস পায়নি।

আরও এক পরিবেশক বলেন, আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলা হয়েছিল। আমি বলেছি, ইউএনও দপ্তর থেকে চিঠি করে ডিলারি ছেড়ে দিতে বলুক। আমি ছেড়ে দেব। বিষয়টি সেইভাবে আছে। নিরাপত্তা পেলে আমি চাল তুলে বিতরণ করতে প্রস্তুত আছি।

উপজেলা খাদ্য অফিসসহ একাধিক পরিবেশক বলছেন, সরকার ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে চাল কিনে ভর্তুকি দিয়ে ১৩ টাকায় পরিবেশকদের চাল দিচ্ছেন। সেই হিসেবে প্রতি পরিবেশককে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার চাল দেওয়া হয়। এই চাল উত্তোলন করে পরিবেশকের ঘরে নেওয়ার পথে যদি বেহাত হয়ে যায়। সঠিকভাবে বিতরণ করা না যায় তখন তার দায় সংশ্লিষ্ট পরিবেশকের উপর বর্তাবে। তাঁকে বাড়তি জরিমানা গুনতে হবে।

পরিবেশকেরা বলছেন, উপকারভোগীদের কাছে ১৫ টাকায় চাল বিক্রি করে আমাদের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। চাল বেহাত হলে তখন লাখ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। এই ভয়ে আমরা চাল নিতে সাহস পাচ্ছি না।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের চালের বরাদ্দের চিঠি এসেছে ১৯ আগষ্ট। চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে চাল উত্তোলনের জন্য পরিবেশকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। কোন পরিবেশক এখন পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চাল তোলেননি। ইন্দ্রোজিৎ সাহা আরও বলেন, কয়েকজন পরিবেশক আমাদের জানিয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা চাল বিতরণের জন্য উত্তোলন করতে নিরাপদ মনে করছেন না। অনেক পরিবেশক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় থেকে চাল উত্তোলনের সময় বাড়িয়ে ২২ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে ডিলারশীপ প্রত্যাহারের জন্য যেসব পরিবেশকদের চাপ দিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে সেসব কাগজপত্র ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে জমা পড়েছে। বর্তমান পরিবেশকেরা চাল না তুললে নতুন পরিবেশক নিয়োগ দেওয়া হবে।

ইতিমধ্যে ডিলারশীপ পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছে। এই নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সভাপতি ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। দেখি কি হয়।

ছবি : মনিরামপুর উপজেলা খাদ্য গুদাম।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

বিনামূল্যে ব্রেকিং নিউজ পেতে ok ক্লিক করুন OK .

খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি-আতঙ্কে বরাদ্দ চাল তুলছেন না পরিবেশকেরা

Update Time : 02:09:55 pm, Wednesday, 11 September 2024

যশোরের মনিরামপুরে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির কার্ডধারী গ্রাহকদের মাঝে সেপ্টেম্বর মাসের চাল বিতরণের জন্য ৭০০ টন চালের বরাদ্দ এসেছে গেল আগষ্ট মাসে। চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে চাল তুলে বিতরণের জন্য পরিবেশকদের নির্দেশনা দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত কোন পরিবেশক ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চাল উত্তোলন করেননি বলে জানা গেছে।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, মনিরামপুর উপজেলায় খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২৩ হাজার ১৯৫ জন উপকারভোগী রয়েছেন। উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে উপকারভোগীদের কাছে ১৫ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল বিক্রির জন্য পরিবেশক রয়েছে ৪৬ জন। যাদের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। গেল ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব পরিবেশকদের অধিকাংশের কাছ থেকে জোর করে কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে ডিলারশীপ কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পরিবেশক জানান, বছরের মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এই পাঁচ মাস কার্ডধারীদের কাছে চাল বিক্রি করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের চাল বিতরণের জন্য গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার খাদ্য অফিস থেকে আমাদের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হয়েছে, আমরা চাল উত্তোলন করব কি না। তাঁরা ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ জবাব চেয়েছেন। পরে আমরা পরিবেশকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপদে চাল তুলে বিতরণ করতে পারব কি না সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। এজন্য কেউ চাল তুলতে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়নি।

নাম প্রকাশ না করে এক পরিবেশক বলেছেন, রাজনীতির পট পরিবর্তনের পর থেকে চালের ডিলারশীপ ছেড়ে দিতে আমাকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। অবশেষে ২০-২৫ জন লোক আমাকে মাঠের মধ্যে কাজ করা অবস্থায় সেখানে ধরে জোর করে প্রত্যাহার কাগজে স্বাক্ষর করে নিয়েছে। লোকজন সরে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি উপজেলা কমিটিকে ফোনে জানিয়েছি। আরেক পরিবেশক জানান, অনেক লোক এসে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে। পরিস্থিতি দেখে কথা বলতে সাহস পায়নি।

আরও এক পরিবেশক বলেন, আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলা হয়েছিল। আমি বলেছি, ইউএনও দপ্তর থেকে চিঠি করে ডিলারি ছেড়ে দিতে বলুক। আমি ছেড়ে দেব। বিষয়টি সেইভাবে আছে। নিরাপত্তা পেলে আমি চাল তুলে বিতরণ করতে প্রস্তুত আছি।

উপজেলা খাদ্য অফিসসহ একাধিক পরিবেশক বলছেন, সরকার ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে চাল কিনে ভর্তুকি দিয়ে ১৩ টাকায় পরিবেশকদের চাল দিচ্ছেন। সেই হিসেবে প্রতি পরিবেশককে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার চাল দেওয়া হয়। এই চাল উত্তোলন করে পরিবেশকের ঘরে নেওয়ার পথে যদি বেহাত হয়ে যায়। সঠিকভাবে বিতরণ করা না যায় তখন তার দায় সংশ্লিষ্ট পরিবেশকের উপর বর্তাবে। তাঁকে বাড়তি জরিমানা গুনতে হবে।

পরিবেশকেরা বলছেন, উপকারভোগীদের কাছে ১৫ টাকায় চাল বিক্রি করে আমাদের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। চাল বেহাত হলে তখন লাখ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। এই ভয়ে আমরা চাল নিতে সাহস পাচ্ছি না।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের চালের বরাদ্দের চিঠি এসেছে ১৯ আগষ্ট। চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে চাল উত্তোলনের জন্য পরিবেশকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। কোন পরিবেশক এখন পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চাল তোলেননি। ইন্দ্রোজিৎ সাহা আরও বলেন, কয়েকজন পরিবেশক আমাদের জানিয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা চাল বিতরণের জন্য উত্তোলন করতে নিরাপদ মনে করছেন না। অনেক পরিবেশক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় থেকে চাল উত্তোলনের সময় বাড়িয়ে ২২ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে ডিলারশীপ প্রত্যাহারের জন্য যেসব পরিবেশকদের চাপ দিয়ে কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে সেসব কাগজপত্র ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে জমা পড়েছে। বর্তমান পরিবেশকেরা চাল না তুললে নতুন পরিবেশক নিয়োগ দেওয়া হবে।

ইতিমধ্যে ডিলারশীপ পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছে। এই নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সভাপতি ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। দেখি কি হয়।

ছবি : মনিরামপুর উপজেলা খাদ্য গুদাম।