
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট ক্রমশ জটিল ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থনৈতিক সমীকরণ, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পটভূমি প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। বৈশ্বিক এই অস্থির পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির জন্য বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনগুলোর মধ্যে নিজস্ব ভূমিকা সুসংহত করা এবং সঠিকভাবে অবস্থান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থানকে ব্যবহার করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথ সুগম করা দরকার।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূমিকাঃ
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করা বাংলাদেশকে পাশ্ববর্তী দুই পরাশক্তি—চীন এবং ভারতের—মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মতো বৃহৎ প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিও এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী সামরিক এবং কৌশলগত প্রভাব তৈরি করার চেষ্টা করছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা এবং জলপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান রুটগুলোর একটি, এবং এই অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বড় শক্তিগুলো ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। সমুদ্রসম্পদের ব্যবহার এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাঃ
বাংলাদেশ এখন একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প, কৃষি এবং প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি দেশকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। তবে বৈশ্বিক চাহিদা এবং প্রতিযোগিতার কথা মাথায় রেখে আমাদের রপ্তানি পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্য করার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, বরং তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য উচ্চ মূল্য সংযোজনকারী পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া উচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার উদীয়মান বাজারগুলোতেও নজর দিতে হবে।
চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিঃ
বাংলাদেশকে বর্তমানে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট এখন একটি বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে এই সংকটের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে না পারলে এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিতে বড় আকারে প্রভাব ফেলতে পারে।
তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী হুমকি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষাঃ
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন “বন্ধুত্বপূর্ণ সবার সঙ্গে, শত্রুতা কারো সঙ্গে নয়” নীতির উপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই নীতি টিকিয়ে রাখা যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা ততটা সহজ নয়। চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের একটি সুদক্ষ কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োজন।
বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা। বাংলাদেশ, এই অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করতে পারে, বিশেষত সার্ক এবং বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামগুলোকে পুনর্জীবিত করার মাধ্যমে।
ভবিষ্যতের জন্য আমাদের করণীয়ঃ
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় ভূমিকায় রয়েছে। তবে আমাদের আরও দক্ষতা এবং দূরদর্শিতার প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রয়োজন, বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে। তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়ও অগ্রগামী হতে পারবে।
উপসংহারঃ
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো শুধু দেশীয় স্বার্থে নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় নিয়ে গৃহীত হওয়া উচিত। দক্ষ নেতৃত্ব এবং সুপরিকল্পিত নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। আমাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপ, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং সামাজিক উন্নয়নকে আরও সুসংহত করে একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল, এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার সময় এখনই।
লেখক: প্রফেসর আসাদুজ্জামান সুমন, প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক