অর্থ-সম্পদের নেশা যেন পেয়ে বসেছিল বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনের পাঁচবারের এমপি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে। দৃশ্যমান কোনো আয় না থাকলেও কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। বিদেশেও রয়েছে তার বাড়িসহ বিপুল বিত্ত। নির্বাচনি এলাকায় জনপ্রিয়তা খুব একটা না থাকলেও বারবার তাকেই নৌকার মনোনয়ন দিয়েছে দল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মোট ৭ বার দলীয় মনোনয়ন পাওয়া এই নেতা ২ বার হেরেছেন নিজ দলের বিদ্রোহী আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। কথিত আছে, প্রতিবেশী দেশের কোটায় বারবার তাকে মনোনয়ন দিত আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সরোয়ার টুকুর কাছে হেরে যান তিনি। একমাত্র ছেলে সুনাম দেবনাথকে মাদক বাণিজ্যে সহায়তার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলা যায়নি সাবেক এই এমপির সঙ্গে। ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি। গেল সপ্তাহে শম্ভুর অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
শম্ভুর যত সম্পদ : বিভিন্ন নির্বাচনে তার দাখিল করা হলফনামার হিসাবেই গত ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে শম্ভুর সম্পদ। এই সময়ে তার স্ত্রীর সম্পদও বেড়েছে কয়েক গুণ। যদিও বাস্তবে আরও অনেক বেশি সম্পদের মালিক তিনি-অভিযোগ বরগুনার বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় মাত্র ২১ লাখ ১১ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন শম্ভু। এছাড়া বরগুনা শহরের হাইস্কুল সড়কে ৩.২০ শতক জমির ওপর একতলা বাড়ি, দুটি টিনের ঘর, দশমিক ২০ একর অকৃষি জমি, ব্যাংকে ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা জমা দেখান তিনি।
স্ত্রীর নামে ঢাকার গুলশানে ২৯ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে ১২ লাখ টাকা আমানত দেখানো হয়। ২০১৪ তে এসে দেখা যায়, একলাফে ২১ লাখ থেকে বেড়ে তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। একই সঙ্গে স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ ৪১ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ লাখের বেশি। ওই নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় নিজের নামে একটি ল্যান্ডক্রুজার আর একটি টয়োটা গাড়ি দেখান শম্ভু। সেই সঙ্গে দেখানো হয় একটি শটগান ও একটি পিস্তলের মালিকানা। অকৃষি জমি বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন আরেকটি বাড়ির মালিকানার কথাও উল্লেখ করা হয় ২০১৪-এর হলফনামায়। সর্বশেষ ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় আরেকবার লাফ দেয় শম্ভুর সম্পদ। এবার তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ২ কোটি ১৩ লাখ ৯১ হাজার ১৯০ টাকা। যার মধ্যে নগদ টাকার পরিমাণ দেড় কোটিরও বেশি। অথচ ২০০৮-এর হলফনামায় ব্যাংকে মাত্র ৯ লাখ টাকা থাকার কথা বলেছিলেন তিনি।
সেই সঙ্গে ২০১৪-এর তুলনায় সব সেক্টরেই বাড়তি দেখানো হয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। তিনটি জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দাখিল করা এসব হলফনামায় নিজের আয় হিসাবে পরামর্শক, সংসদ-সদস্য হিসাবে বেতন-ভাতা ও স্ত্রীর ব্যবসা দেখানো হলেও আইনজীবী হিসাবে শম্ভুকে যেমন খুব একটা দেখা যায়নি আদালতে, তেমনি তার স্ত্রীর ব্যবসার বিষয়টিও রয়েছে অন্ধকারে। ২০১৪ তে তার বার্ষিক আয় ছিল ২৪ লাখ ৮৬ হাজার, ২০১৮ তে এসে ৪৫ লাখ ১৫ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। হলফনামার হিসাবেই ১০ বছরে ১০ গুণ সম্পদের মালিক হওয়া শম্ভুর আরও সম্পদ রয়েছে, যার উল্লেখ নেই কোথাও। এসব সম্পদের প্রায় পুরোটাই তিনি স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ নানা বেনামে করেছেন বলে জানা গেছে। বরগুনার একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশানে ৩ হাজার ৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে শম্ভুর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং প্রিয়প্রাঙ্গণে রয়েছে স্ত্রী-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ৪টি প্লট। ১ হাজার ৩০০ বর্গফুট আয়তনের ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে মধ্য বাড্ডায়। নিজেরসহ স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের নামে রয়েছে ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। বরগুনা মহাসড়ক এলাকায় এক একরেরও বেশি জমি কিনেছেন ছেলে সুনাম দেবনাথ।
বরগুনার তালতলী উপজেলার ৪২নং মৌজার বড় নিশানবাড়ির ৪০৪ নম্বর খতিয়ানে রয়েছে ১৭.৫২ একর জমি। রাখাইনদের সঙ্গে প্রতারণা করে ওই জমির মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে শম্ভুর বিরুদ্ধে। গাজীপুরে রয়েছে নিজস্ব জমিতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। আমতলী পৌরসভা এলাকায়ও জমি রয়েছে তার। এছাড়া ভারতের সল্টলেক এলাকায় তার বিশাল বাড়ি রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। কথিত আছে, ওই বাড়ি নির্মাণে বরগুনা থেকে পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে ভারতে শ্রমিক নিয়েছিলেন সাবেক এই এমপি। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার বাড়ি ও সম্পত্তি থাকার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।
বরগুনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম আহাদের ভাইরাল হওয়া এক অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, প্রকল্পের বরাদ্দ প্রশ্নে সংসদ-সদস্য শম্ভুকে অর্ধেক টাকা দিয়ে তারপর আনতে হয় কাজ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৩৩টি টিআর প্রকল্পে ১ কোটি ৭৫ লাখ ও ৪৭টি কাবিখা/কাবিটা প্রকল্পে ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ পান তিনি। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের একটিতেও কোনো কাজ না করে তুলে নেওয়া হয় টাকা। সংসদ-সদস্য থাকাকালে শম্ভুর বিরুদ্ধে একবার ঘুস, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ ২৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অন্যান্য নেতারা। সে সময় তাকে বরগুনায় অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছিলেন তারা।
মাদক বাণিজ্যে শম্ভুর ছেলে : শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে আছে মাদক ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর বরগুনা ছিল মাদক চোরাচালানের অন্যতম একটি কেন্দ্র। সাগর পারের বরগুনা থেকে মাদকের চালান যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেন সুনাম। জেলা পুলিশের দেয়া গোপন প্রতিবেদনেও মাদক বাণিজ্যের হোতা হিসাবে নাম ছিল সুনামের। সুনামের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে মাদক বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগ পর্যন্ত আনেন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুবায়ের আদনান অনীক।
বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যাকাণ্ড ও কিশোর গ্যাং লিডার নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের ঘটনাও এই মাদকের কারণেই হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি শম্ভুকে। তার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। পরিবারের অন্য কারও মোবাইল ফোনও খোলা পাওয়া যায়নি।
যুগান্তর পত্রিকা থেকে নেয়া
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ বি এম মনিরুজ্জামান
নির্বাহী সম্পাদক: রিপন রুদ্র
যুগ্ম-সম্পাদক: জাকিয়া সুলতানা (লাভলী)