লক্ষীপুর নন্দন অটিজম এন্ড এনডিটি স্কুল। ফেব্রæয়ারির সাত তারিখÑএকটি দিন, যা হয়তো ক্যালেন্ডারের পাতায় নীরবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে পড়ে থাকে, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত চিৎকার আমাদের ব্যস্ত শহরের কোলাহলে হারিয়ে যায়। এ দিনটি "বাংলা ইশারা ভাষা দিবস," যে ভাষার কোনো শব্দ নেই, তবু তার গভীরে রয়েছে অনুভ‚তির বিস্ফোরণ; যার কোনো চিৎকার নেই, তবু প্রতিবাদের তীক্ষèতা আছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও, বাস্তবে তা উদযাপনের চেয়ে অবহেলার ঝুলিতে বেশি ঠাঁই পেয়েছে। ইশারা ভাষার ব্যবহারকারীরা আজও সমাজের এক নীরব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাদের কথা কেউ শুনতে চায় না, যাদের ভাষা বোঝার প্রয়াস নেওয়া হয় না। অথচ, যদি একবার কেউ বোঝার চেষ্টা করত, তাহলে দেখতÑএই ভাষা শুধু নীরব ইঙ্গিত নয়, এটি হাজারো মনের অনুভ‚তির এক বহমান স্রোত। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক সুযোগ-সুবিধায় তারা রয়ে গেছে এক অদৃশ্য পরিসরে। চাকরির বাজারে তারা যেন নেই, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন" ট্যাগের আড়ালে তারা হারিয়ে যায়, আর স্বাস্থ্যসেবায়? সেখানে তো ডাক্তারদের ঠোঁটের নড়াচড়া পড়ে অনুমান করাই যেন তাদের নিয়তি!
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়, অথচ তাদের জন্য সংবাদপাঠকের পাশে থাকা ইশারা ভাষার দোভাষী যেন এক দুর্লভ বিলাসিতা। দেশের শত শত টিভি চ্যানেলের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দয়া করে দোভাষী রাখে, অথচ এটা কোনো করুণা নয়, এটি তাদের অধিকার। বাংলাদেশে ইশারা ভাষার দোভাষীর সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনÑএকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এটি লজ্জাজনক নয়? শিক্ষাক্ষেত্রে একদম গোড়া থেকেই সমস্যা। শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি করা হলেও সেই শিক্ষাব্যবস্থা কতটা কার্যকর? শিক্ষক কোথায়? সরকারি নীতিতে "ইনক্লুসিভ এডুকেশন" শব্দটি থাকলেও বাস্তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা তাদের জন্য প্রায়শই বন্ধ থাকে। চাকরির ক্ষেত্রে তো অবস্থা আরও করুণ। কোনো অফিসে গেলে তারা প্রায়ই শুনতে পান, "আপনার সাথে কথা বলতে পারবো না, অন্য কাউকে পাঠান।" এমন সংলাপ শুনতে শুনতে তাদের মনের কণ্ঠরোধ হয়ে যায়, সমাজ যেন তাদের কণ্ঠকে থামিয়ে দিতে চায়!
স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও ভয়াবহ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ইশারা ভাষায় দক্ষ কোনো ডাক্তার নেই। একজন মানুষ নিজের শরীরের সমস্যার কথা আরেকজনের মাধ্যমে বলতে বাধ্যÑএটি কতটা অপমানজনক! একজন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী রোগীকে হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে একজন দোভাষী খুঁজতে হয়, যে তার অসুখের কথা ডাক্তারকে বুঝিয়ে দেবে। ভাবা যায়? এ সমাজ সভ্যতার বুলি আওড়ায়, কিন্তু তার ভিতরে এখনো ন্যূনতম মানবিক সংবেদনশীলতাও নেই। আমরা এক তথাকথিত মুক্ত সমাজের বাসিন্দা, যেখানে বাকস্বাধীনতার জয়গান গাওয়া হয়, অথচ এমন কিছু মানুষ আছে, যারা শব্দ ছাড়াই কথা বলতে চায়, অথচ সমাজ সেই ভাষাকে বোঝার চেষ্টাও করে না। এটি কি আরেক ধরনের "বাকরুদ্ধতা" নয়? একটি ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই কেবল মুখের ভাষার জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে? ৭ ফেব্রæয়ারি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, এটি এক আন্দোলনের দিন। এটি নীরব সৈনিকদের অধিকার আদায়ের দিন। শুধু বাংলা ভাষার জন্য নয়, বাংলা ইশারা ভাষার জন্যও মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে, দাবি তুলতে হবেÑ"শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয়, বরং তারা অবহেলার শিকার। শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, গণমাধ্যমÑসবকিছুতেই তাদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে চায়, তাহলে শুধু মুখের ভাষার জন্য নয়, হাতের ভাষার জন্যও সংগ্রাম করতে হবে। এই ভাষাকে মর্যাদা না দিলে, আমরা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার দাবিই বা করবো কীভাবে? ইশারা ভাষা কোনো শব্দহীন ভাষা নয়Ñএটি অনুভ‚তির ভাষা, এটি একেকটি মনের প্রতিবাদের ভাষা। যদি একবার তাদের দৃষ্টির গভীরে তাকানো যায়, তবে দেখা যাবেÑসেই চোখে লেখা আছে এক নীরব মহাকাব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই মহাকাব্য শোনার যোগ্যতা আমাদের সমাজ এখনও অর্জন করতে পারেনি!
----------
বাংলা ইশারা ভাষা নীরব প্রতিবাদ ও অধিকার সংগ্রামের ভাষা
উজ্জ্বল ভট্টাচার্য্য
সার্বিক সহযোগিতা :
ল²ীপুর নন্দন অটিজম এন্ড এনডিডি স্কুল।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ বি এম মনিরুজ্জামান
নির্বাহী সম্পাদক: রিপন রুদ্র
যুগ্ম-সম্পাদক: জাকিয়া সুলতানা (লাভলী)